‘এক বিন্দু ভালোবাসা দাও
আমি এক সিন্ধু হৃদয় দেব,
মনে প্রাণে আছ তুমি
চিরদিনই আমি তোমার হব’
বেশ মিষ্টি গান। কয়েক বছর আগে গানটি শুনে ভালো লেগেছিল। পরিচিত হয়েছিলাম শাকিব খান- অপু অপু বিশ্বাস জুটির সাথে। দু’জনকে মানিয়েও ছিল বেশ। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রের বেশ কয়েকটি ব্যবসাসফল ছবি তারা ইন্ডাষ্ট্রিকে উপহার দিয়েছিলেন। শাকিব-অপু অভিনীত কিছু ছবি দেখার সুযোগ হয়েছিল টিভিতে। মোটামুটি ভালোই লেগেছিল। মিডিয়ায় মাঝে মাঝে টুকটাক গুঞ্জন শুনতাম এদিয়ে নিয়ে। তাঁরা প্রেম করছেন কিংবা বিয়ে করতে যাচ্ছেন- এসব। বরাবরই তাঁরা সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলেছেন ‘বিয়ের সময় হয়নি’ কিংবা ‘আরও ৫ বছর পর’ ইত্যাদি। কিন্তু হঠাৎ গত ১০ এপ্রিল একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে শিশু সন্তানসহ সাক্ষাতকার দিতে উপস্থিত হন অপু বিশ্বাস। সেখানে শাকিব খানকে স্বামী দাবী করে তিনি জানান, ২০০৮ সালেই তাদের বিয়ে হয়েছিল। ২০১৬ সালের শেষের দিকে তাদের সন্তান আব্রাহামের জন্ম হয়। ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে এই অজুহাতে তারা ব্যাপারটা গোপন রেখেছিলেন এবং শাকিবের পরামর্শেই তিনি সন্তানসম্ভবা অবস্থায় কাউকে কিছু না জানিয়ে দেশের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। পরে ৫ মাসের সন্তান কোলে দেশে ফেরেন। বারবার স্ত্রীর স্বীকৃতি চেয়ে ব্যর্থ হয়ে অপু এবার গণমাধ্যমকে জানাতে বাধ্য হয়েছেন। সেদিন চতুর শাকিব সাংবাদিকদের ফোন কলের মুখোমুখি হয়ে সন্তানকে নিজের বলে স্বীকার করেন কিন্তু অপুর দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। অপুও বলে ফেলেন- আমার দায়িত্ব নিতে হবে না, আমি আমার দায়িত্ব নিতে পারব। আমি চাই একটি বাচ্চা মা-বাবা উভয়ের স্নেহমমতা পাক।
ঘটনার ফলোআপ আসবে আরও পারে। সেজন্য আমরা অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। পরদিনই শাকিব ভিন্ন সুরে কথা বলতে থাকেন। অপুকে মেনে নেন। অপুর উপর রাগ থেকেই আগেরদিন এমন করেছিলেন, উনি তখন মাথা ঠিক রাখতে পারেননি- ইত্যাদি।
প্রথম দিন অপুর কান্নাকাটিতে ভাবছিলাম একটা ব্যাপার- পত্রিকার পাতা খুললেই প্রতিনিয়ত নির্যাতিতা, বঞ্চিতা, সহিংসতায় বিধ্বস্ত নারীর খবর পড়ি। তাদের বেশিরভাগই গরীব ঘরের নারী। কিন্তু অপু? কত ছবিতে সংগ্রামী আর সফল নারী চরিত্রে অভিনয় করে তিনি নির্যাতিতা নারীদের আইডল হয়েছেন, অথচ বাস্তব জীবনে? অপুর যদি এই দশা হয় তবে অন্যদের? যেন চিন্তায় কুলাচ্ছিল না। যদিও ব্যাপারটা পরবর্তীতে ভিন্ন দিকে গড়িয়েছে। এমনও হতে পারে অপুর ক্যারিয়ারের ধ্বস ঠেকাতেই এই নাটক- আমি সেদিকে যাচ্ছি না।
মনে পড়ে কয়েক বছর আগে আত্মহননের পথ বেছে নেয়া মিতা নূরের কথা। পর্দায় হাসিখুশী আর সফল এই অভিনেত্রীর সংসার ছিল বিষেভরা। স্বামী সন্তানকে ছোট করতে চাননি বলে জীবিত অবস্থায় কখনও মুখ খোলেননি। কিন্তু শেষ রক্ষাও করতে পারেননি। সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন। ঠিক কী কী হয়েছিল তার সাথে মিডিয়াতে ঠিকভাবে না এলেও যেটুকু এসেছিল তাতে বোঝা যায় দাম্পত্য জীবনে তিনি ছিলেন চরম অসুখী আর নির্যাতিতা এক নারী। অপুর ভাগ্য ভালো। মিডিয়ার দৃষ্টি ফেরাতে এবং সাধারণ মানুষের সহানুভূতি আদায় করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। এসবের কতটুকু ‘নাটক’ আর কতটা বাস্তবতা সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। তবে শাকিব যে তার প্রতি অবহেলা করেছিলেন কিংবা কিছু একটা হয়েছিল- সেটা মোটামুটি নিশ্চিত। (অপু বারবার বলেছিলেন- আমি শাকিবের অবহেলা মেনে নিতে পারছিলাম না) যাই হোক, এখন শাকিব তার সাথে সংসার করুক না করুক, বাচ্চাকে নিয়ে অপু স্বাধীনভাবে বাকি জীবনটা কাটাতে পারবেন। হয়ত অভিনয়েও ফিরে আসবেন।
এবার অপেক্ষাকৃত কম বিত্তবানদের দিকে তাকাই। আমার চেনাজানা কয়েকজন সংগ্রামী নারীর সাথে আপনাদের পরিচয় করাবো।
১। মুনিয়া (ছদ্মনাম) : দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী। স্বামী প্রায় বেকার। ফসলের জমি নেই। ঘর আর উঠোনটাই সম্বল। আর সম্বল বেঁচে থাকার মানসিকতা। মুনিয়া ৩ সন্তান নিয়ে বাড়ির ছোট্ট উঠোনটায় আবাদ করা সবজি আর গাভীর দুধ বেচেই কোনমতে সংসার চালান। স্বামী বাড়ির কাছাকাছি চা দোকানটাতে সারাদিন বসে বসে আড্ডা দেন আর টিভি দেখেন। অথচ ইচ্ছে করলেই রিকশা চালাতে পারেন কিংবা মজুর খাটতে পারেন।
২। শিরিনা (ছদ্মনাম) : বেকার আর বদমেজাজী স্বামী স্বত্ত্বেও আপন মনে ক্ষেতে খামারে কাজ করেন। আর হাঁসমুরগী পালেন। কর্মক্ষম অথচ বেকার স্বামীর অবহেলা অনাদর সত্ত্বেও শিরিনার কোন অভিযোগ নেই। মহিলাটার গায়ের রং তামাটে কিন্তু মুখে হাসি লেগেই থাকে। যেন সংগ্রাম করে ছেলেমেয়ে নিয়ে সমাজে টিকে আছেন, এতেই তাঁর সুখ।
৩। জুলেখা (ছদ্মনাম) : এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। ১২/১৩ বছর আগে পাশের উপজেলার নামমাত্র কর্মজীবী এক যুবকের সাথে বিয়ে হয়েছিল। দেড় কি দুই বছরের সংসার। একটা ছেলে হয়েছে। ওই যুবকটা থাকত ঘরজামাই। তারপরও সে কী দাপট! বউ-ছেলের ভরণপোষণ দিত না। কথায় কথায় মেজাজ দেখাতো। কর্মস্থলেও ঠিকমত যেত না। ফলে চাকরি চলে গেলে। নিজের দাবী আদায়ের জন্য জুলেখা কিছু বললে গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করত না লোকটা। এমনকি মাঝে মাঝে তালাক দেয়ার হুমকিও দিত। অসচ্ছল বাবা-মায়ের বোঝা হতে চাননি বলে নিরবে সইতে না পেরে বাবা-মাকে সব খুলে বললেন। সবাই মিলে ঘরজামাইকে তাড়িয়ে দিল। জুলেখা এবার নড়েচড়ে বসলেন। ধীরে ধীরে নিজের পায়ে দাঁড়ালেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে নার্স হিসেবে চাকরি নিলেন। ছেলে এখন সিক্সে পড়ছে। কিছুদিন আগে দেখা হয়েছিল। বললেন- ‘কারো প্রতি অভিযোগ নেই, আমি ভালো আছি’। বিয়ে করবেন না? আমার এই প্রশ্নের জবাবে দৃঢ়তার সাথে জানালেন- ‘না’। বেকার স্বামী তাও আবার বদমেজাজী, অহেতুক খবরদারী করে, কারণে-অকারণে মারধরও করে, অনেক চেষ্টা করেও সংসারে সচ্ছলতা আনতে পারছেন না, বাপের বাড়ি থেকেও সাপোর্ট আসছে না, তাই ‘এ জীবন রেখে আর কী হবে?’ জাতির কথা এদের কেউ মাথায় আনেননি।
মিতা নূরের সাথে মিলে যায় এমন বহু নারী আছেন। (অবশ্য এদের ‘আছেন’ না বলে ‘গেছেন’ বলাই শ্রেয়। কারণ পরিস্থিতির কাছে হেরে গিয়ে তারা স্বেচ্ছায় চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে।) এদের একজনের কথা বলছি। তাঁকে দেখেছিলাম হাসপাতালে। তখন তিনি মৃত্যুশয্যায়। স্বামীর সাথে অভিমান করে বিষ খেয়েছিলেন। আমার অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে আমি সেদিন ফেনী সদর হাসপাতালের মহিলা ও শিশু ওয়ার্ডে ছিলাম। কে যেন মহিলাটিকে এনে ভর্তি করিয়েছিলেন। প্রাথমিক ধাক্কা সামলিয়ে ওয়ার্ডে এনে ভর্তি করালেও শেষ পর্যন্ত মহিলাটি মারা যান। মৃত্যুর আগে সেই স্বামীটি হাসপাতালে এসেছিলেন। দু’জনকে কথা বলতেও দেখেছি। ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম আমি। হঠাৎ শুনলাম মহিলাটি মারা গেছেন। গিয়ে দেখে এলাম। দীর্ঘক্ষণ মহিলাটির মরা মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। আহা! কত অভিমান ছিল! কী নিষ্পাপ মুখ! একটা পর্যায়ে স্বামী এলেন। জড়িয়ে ধরে কাঁদলেনও (নাকি কাঁদার ভান?)। ওয়ার্ডের রোগী এবং রোগীর সাথে আসা লোকজন ধীরে ধীরে যে যার মতো চলে গেলেন। আমি তখনও তাকিয়ে। হঠাৎ দেখলাম লোকটা এদিক ওদিক তাকিয়ে মহিলার কান থেকে দুলগুলো খুলে নিয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। আমি ভাবলাম গরীব মানুষ। হয়ত কাফন দাফনের খরচের টাকাটা জোগাড় করার জন্য বিক্রি করতে নিয়ে গেছেন। লাশটি পড়ে রইল। সারারাত মহিলার লাশ নিতে কেউ আর এলেন না। পরদিন তার এক ভাই এসে লাশ নিয়ে যান। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কার উপর রাগ, অভিমান করে এই আত্মহনন? কী লাভ হল? আলোচিত আত্মহননকারী রীতা, বিলাসী, জাহানারা কিংবা উঁচুতলার মিতা নূর এদের আত্মহননে কারও কোন ক্ষতি হয়েছে? আত্মহননে প্ররোচনাদানকারীদের কিছু হয়েছে? না, হয়নি। হয়তো হবেও না।
এখন মনে হচ্ছে অপু বিশ্বাসের সাথে প্রথম দিকে বলা ৩জন নারীর এক জায়গায় খুব মিল আছে। তা হলো- টিকে থাকার লড়াইয়ের মানসিকতা। তারা মিতা নূরের মতো করেননি। করবেনও না, আশা করি। যারা প্রতিকুলতাকে ডিঙ্গিয়ে বাঁচতে পারেন তারাই তো মানুষ। নারীদের ইসলাম ধর্মে বিশেষ অধিকার দিয়েছে। সে অধিকার অনেকেই পাচ্ছেন না। পৈতৃক সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার থাকলেও সেটাও অনেকে পান না। আবার পেলেও নামমাত্র পান। তাই শুধু স্বামী দ্বারা নয়, আপনজনের কাছে থেকেও নারীরা অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত, নিগৃহীত। নারীকে তার প্রাপ্য অধিকারটুকু দিচ্ছে না। আমি বলব- ‘দিচ্ছে না’ নয় বরং নারীকে পরিবারের সদস্যদের যোগ্য সম্মান দেবার ক্ষমতাই নেই। শুধু তাই নয়, অধিকার আদায় করতে গেলে কোন কোন ক্ষেত্রে সহিংসতার শিকারও হতে হচ্ছে। বাইরের লোক দ্বারা ধর্ষিত কিংবা নির্যাতিত হবার কথা না হয় বাদই দিলাম। আমার মনে হয় সবচেয়ে দুঃখজনক এই পারিবারিক নির্যাতন, আর আপনজনের দেয়া বঞ্চনা। তাই বলে দুঃখ পেয়ে বসে থাকলে চলবে? ভাবা যাবে- ‘এ জীবন রেখে আর কি লাভ?’ কখ্খনো না। নারীকে হতে হবে মুনিয়া শিরিনা, জুলেখা কিংবা একজন অপু বিশ্বাস।
সবশেষে বলি- জুতো কেনার টাকা নেই বলে আক্ষেপ না করে আপাতত ‘পা যে আছে’ সেই সন্তুষ্টিতে থাকা উচিত। তবেই পায়ে হেঁটে রোজগার করে জুতো কেনার টাকা জোগানো যাবে। তাহলেই ‘টিকতে’ পারবে। আর টিকতে টিকতে নারী একদিন তার প্রাপ্যটুকু বুঝে নিতে পারবে।
# লেখক : প্রধান শিক্ষক, চেওরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা ২০১৫ ফেনী জেলা।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
- » বাংলাদেশ সম্মিলিত শিক্ষক সমাজ ফেনী জেলা আহবায়ক কমিটি গঠিত
- » ফেনী বন্ধুসভার বৃক্ষরোপণ ও বিতরণ
- » আমার দেশ সম্পাদকের রত্নগর্ভা মাতা অধ্যাপিকা মাহমুদা বেগমের মাগফিরাত কামনায় ফেনীতে দোয়া
- » গাজীপুরে সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদে ফেনীতে সাংবাদিকদের মানববন্ধন
- » ফেনীতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাংবাদিকদের উপর হামলার গোপন পরিকল্পনা ফাঁস
- » জনতার অধিকার পার্টির চেয়ারম্যানের উপর হামলা, সংবাদ সম্মেলন
- » ফেনী পৌর বিএনপির সদস্য নবায়ন কর্মসূচি উদ্বোধন
- » ফেনীতে হেফাজতের দোয়া মাহফিলে আজিজুল হক ইসলামাবাদী- ‘আলেম সমাজ ঐক্যবদ্ধ থাকলে দেশে আর ফ্যাসিবাদ সৃষ্টি হবে না’
- » ফেনীতে হাফেজ তৈয়ব রহ. স্মরণে দোয়ার মাহফিল
- » ছাত্র জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে ফেনীতে বিএনপি’র বর্ণাঢ্য বিজয় মিছিল, সমাবেশ “গণহত্যার দ্রুত বিচার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি”